লাগামহীন নিয়োগ দুর্নীতি বন্ধ করে  যোগ্য প্রার্থীর চাকরি নিশ্চিত করতে হবে

RanaRana
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  10:45 AM, 10 November 2021

☆ জেমস আব্দুর রহিম রানা ☆ 
রাষ্ট্রপতির কাছে দেয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাম্প্রতিক এক বার্ষিক প্রতিবেদনে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সরকারি সংস্থায় নিয়োগে দুর্নীতি-অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির যে চিত্র উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক। দুদকের প্রতিবেদনটিতে মন্তব্য করা হয়েছে- নিয়োগে আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির ‘আঁতুড়ঘর’।
দুদকের কাছে নিয়োগ দুর্নীতির প্রচুর অভিযোগ আসে। এর সত্যতাও পেয়েছে দুদক। বস্তুত সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে, তা নিয়ে দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ নেই।
খোদ সরকারের পক্ষ থেকেও দুর্নীতির অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। দুর্নীতির বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। বলা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির সূত্রপাত ঘটে শুরু থেকেই।
অর্থাৎ যারা ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পায়, পরবর্তী সময়ে তারা আরও বেশি দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। একপর্যায়ে তারা ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অন্যদের নিয়োগ দেয়। আর এভাবেই চলে আসছে দুর্নীতি। প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতির এই দুষ্টচক্রের কারণেই সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি রোধ করা যাচ্ছে না। দুর্নীতি দমন করতে চাইলে ভেঙে ফেলতে হবে এ দুষ্টচক্র।
অভিযোগ আছে, স্থানীয় দলীয় রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে জাতীয় রাজনীতির প্রভাবশালী ব্যক্তি পর্যন্ত নিয়োগে ঘুষ-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নেন। প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রেও এ ধরনের অভিযোগ শোনা যায়।
দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব কাজে লাগিয়ে একটি শ্রেণী অব্যাহতভাবে দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণ প্রক্রিয়াও দুর্নীতিকে উসকে দিচ্ছে। জানা যায়, সরকারি চাকরিতে বেতন বৃদ্ধির পর এ ধরনের নিয়োগে অবৈধ অর্থের পরিমাণও বেড়ে গেছে।
তাই মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থায় নিয়োগ নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর নিয়োগের ক্ষেত্রেই অনিয়ম, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ বেশি।
বেশির ভাগ নিয়োগে ঘুষ-দুর্নীতি, অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতির কারণে বাদ পড়ছেন যোগ্য ও মেধাবীরা। ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাষ্ট্র। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অযোগ্যরা নিয়োগ পাওয়ার ফলে সক্ষমতা হারাচ্ছে প্রশাসন।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়োগ নিয়ে আদালতের শরণাপন্নও হতে হচ্ছে চাকরিপ্রত্যাশীদের। এ পরিস্থিতি নিরসনে নিয়োগে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের দাবি দীর্ঘদিনের। যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি লাভ প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। যে বা যারা এই অধিকার হরণ করছে তারা গর্হিত অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। এ প্রবণতা বন্ধ করা দরকার কঠোরভাবে।
অতি সম্প্রতি যশোরের মনিরামপুরে আয়া পদে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ঘুষ নিয়ে চাকরি কিংবা টাকা কোনটাই ফেরত না দেওয়ায় সভাপতিকে জুতা দিয়ে পিটিয়েছেন এক নারী প্রার্থী। উপজেলার মনোহরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সিরাজুল ইসলামকে এমন লাঞ্ছনা করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে নিয়োগ বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ ।
অভিযোগ মতে সম্প্রতি মনোহরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আয়া ও দপ্তরিসহ মোট চারজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী আয়া পদে কুলসুম বেগম, দপ্তরি পদে সভাপতির চাচাত ভাই মোহাম্মদ আলীসহ চার পদে মোট ১৬ জন প্রার্থী আবেদন করেন। আবেদনপত্র যাচাবাছাই শেষে নিয়োগবোর্ডে অংশ নিতে সবাইকে চিঠি দেওয়া হয়।
কুলসুম বেগমের অভিযোগ, আয়া পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ছয়মাস আগে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এমদাদুল হক দুই দফায় ঘুষ বাবদ তার কাছ থেকে অগ্রিম মোট ছয়লাখ টাকা নেন। অলিখিত চুক্তি অনুযায়ী চাকরির পর সভাপতিকে আরও দুই লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল। গত ৪ নভেম্বর সকালে মনিরামপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে আয়োজন করা হয় নিয়োগ বোর্ডের।
কুলসুম বেগম জানান, নিয়োগ বোর্ডের আগের রাতে সভাপতি তাকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সরবরাহ করেন। কুলসুম বেগমসহ সব প্রার্থী পরীক্ষায় অংশ নেন। কিন্তু চার পদের মধ্যে আয়া পদে তাকে চাকরি দেওয়া হয়নি। তার অভিযোগ, ১১ লাখ টাকার বিনিময়ে আয়া পদে কোনরকম আবেদন ছাড়াই চাকরি দেওয়া হয়েছে স্থানীয় সংরক্ষিত ওয়ার্ড মেম্বর আসমা খাতুনকে। অন্যদিকে দপ্তরি পদে ১০ লাখ টাকা নিয়ে চাকরি দেওয়া হয়েছে সভাপতির আপন চাচাতো ভাই মোহাম্মদ আলীকে।
যদিও আসমা খাতুন এবং মোহাম্মদ আলী চাকরি পাবার পর ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু বিদ‍্যালয়ের সাবেক সভাপতি ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি কালিপদ মন্ডল জানান, চার পদে নিয়োগ দিয়ে সভাপতি প্রায় অর্ধকোটি টাকা ঘুষবাণিজ্য করেছেন। একই অভিযোগ করেন অভিভাবক সদস্য ওয়াজেদ আলীসহ অনেকেই।
এদিকে আয়া পদে চাকরি না পেয়ে কুলসুম বেগম গত শুক্রবার ( ৫ নভেম্বর ) সকালে মনোহরপুর কাঁচারীবাড়ি বাজারে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সিরাজুল ইসলামের কাছে ঘুষের ছয়লাখ টাকা ফেরত চান। প্রত্যক্ষদর্শী আবদুস সাত্তারসহ অনেকেই জানান, সিরাজুল ইসলাম টাকা ফেরত দিতে অস্বীকার করলে দুজনের মধ্যে ব্যাপক কথাকাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে কুলসুম বেগম তাকে লাঞ্চিত করাসহ জুতাপেটা করেন। এ সময় সিরাজুল ইসলামকে রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে আসেনি।
এছাড়া চার কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগে পরদিন শনিবার বিকেলে স্কুল মাঠে বিক্ষোভ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন কুলসুম বেগমের স্বামী আবদুল ওয়াদুদ, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি কালিপদ মন্ডল, সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক সিদ্দিকুর রহমান, অভিভাবক সদস্য ওয়াজেদ আলী সরদার, আলী আযম বাচ্চু, আবদুস সাত্তার প্রমুখ।
সভায় বক্তরা সিরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের নামে প্রায় অর্ধকোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরে চার কর্মচারী কথিত নিয়োগ বাতিল করা সহ তার বিচারের দাবি করেন।
তবে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ অস্বীকার করে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, সমাজে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে তার দলের প্রতিপক্ষরা ষড়যন্ত্র করে বিভিন্ন কুৎসা রটাচ্ছেন। একইভাবে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এমদাদুল হকও ঘুষের টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন।
এতকিছুর পরও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বিকাশ চন্দ্র সরকার জানান, চকুরি দেওয়ার জন্য ঘুষ নেওয়া হয়েছে কি-না তা তার জানা নেই। তবে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সৈয়দ জাকির হাসান জানান,  লিখিত অভিযোগ করা হলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে মোতাবেক এলাকার হাজার হাজার মানুষের গণস্বাক্ষর সহ অভিযোগ দেয়া হয়েছে বিভিন্ন দফতরে।  যদিও নিয়োগে দুর্নীতি বন্ধে বেশকিছু সুপারিশ করে দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংবিধানের ১৩৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে এক বা একাধিক সরকারি কর্মকমিশন গঠন করা যেতে পারে। এটি করা গেলে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং সংবিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিকে মনোনয়নের উদ্দেশ্যে যাচাই ও পরীক্ষা পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। তারপরও এইসব অনিয়মের সমাধান সাধারণ মানুষের অজানা।
এক্ষেত্রে সংবিধানের ১৪০(১)(গ) অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামোও প্রণয়নের সুযোগ রয়েছে। শুধু স্কুল কলেজে নিয়োগের ক্ষেত্রে দূর্নীতিই নয়, দুর্নীতি এখন বলতে গেলে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। এমন কোনো খাত নেই, যেখানে কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতি হচ্ছে না। আমরা মনে করি, দুর্নীতি রোধে সবার আগে নিয়োগ ক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধ করা জরুরি। শুধুমাত্র নিয়োগে দুর্নীতি রোধ করা গেলেই সামগ্রিকভাবে দুর্নীতি অনেকাংশে কমে আসবে বলে সচেতন মহল মনে করেন। কাজেই নিয়োগ দুর্নীতি বন্ধে দুদকের সুপারিশগুলো আমলে নেয়া হবে, এটাই কাম্য। #
লেখক : জেমস আব্দুর রহিম রানা
কলামিস্ট ও গণমাধ্যমকর্মী 
যশোর, বাংলাদেশ। মোবাইল : 01300832868
ইমেইল : ranadbf@gmail.com

আপনার মতামত লিখুন :